আমাদের দেশে কলসেন্টারের যাত্রা শুরু হয় ২০০৯ সাল থেকে। শুরুর দিকটাতে শুধুমাত্র দেশীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে সাপোর্ট দেওয়া হলেও এ খাত এখন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সাপোর্ট দিয়ে আসছে। প্রতিনিয়ত এ খাতে যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন সেবা। ভয়েস, নন-ভয়েস, গ্রাফিক্স, ডাটা এন্ট্রি, মেডিক্যাল ট্রান্সকিপশন সেবাসহ বেশ গুরুত্বপূর্ণ সেবাগুলো বিপিও প্রতিষ্ঠানরা দিয়ে আসছে।
সম্প্রতি বিপিও খাতের বর্তমান অবস্থা ও আগামির পরিকল্পনা নিয়ে দৈনিক ডিজিটাল সমযের সঙ্গে কথা হয় মাই আউটসোর্সিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার মো. তানজিরুল বাসারের। তার সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনার পর বিস্তারিত লিখেছেন মাহবুব শরীফ
বিপিও খাতের বর্তমান অবস্থা বর্ণনা দিতে গিয়ে তানজিরুল বাসার বলেন,‘বিশ্বের অন্য দেশগুলোর তুলনায় আমরা কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে রয়েছি। এ অবস্থায় আমাদের দরকার এ খাতকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করা। যেমন ধরুন-বিপিও প্রতিষ্ঠানগুলো প্রচুর লোকবল নিয়োগ দিচ্ছে, কিন্তু সঠিক কাজের জন্য সঠিক লোকটিকে খুঁজে চাওয়া কঠিন হচ্ছে। সঠিক কাজের জন্য সঠিক লোককে খুঁজে পেতে হলে এ সেক্টরে হিউম্যান রিসোর্স (এইচআর)-এ গুরুত্ব দিতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘বিপিও খাতে গ্লোবাল মার্কেটিংয়ে আমরা পিছিয়ে রয়েছি। দেশের বিপিও খাতকে বিশ্বব্যপী ব্র্যান্ডিং করা দরকার যাতে বিশ্বের যেকোনো দেশ থেকে আমরা সহজে কাজটি পেতে পারি।’
আন্তর্জাতিক বাজারের কাজ আমাদের দেশে আনতে হলে কী পদক্ষেপ নেওয়া দরকার? এমন প্রশ্নের জবাবে তানজিরুল বাসার বলেন,‘আমরা ডমেস্টিক কাজ করে আসাছি বহু আগে থেকে। আন্তর্জাতিক বাজারেরও কাজ করছি, তবে সেটি তুলনামূলক হারে কম। বিদেশি কাজ আমাদের দেশে আনতে হলে আমাদের দেশে একটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা দরকার, যে প্রতিষ্ঠান বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে কাজ এনে দেশের যে প্রতিষ্ঠানের স্বক্ষমতা রয়েছে সে কাজটি করার তাকে দেবে। এতে করে কাজের পরিসরটা বেড়ে যাবে।’
বর্তমানে বিপিও খাতে আপনারা কীভাবে সব কাজ একত্রে করছেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘বিপিও সেক্টরে আমরা যারা আছি, একসঙ্গে মার্কেটিং করছি এবং অপারশেনও চালাচ্ছি। ফলে আমাদের পক্ষে অনেক কঠিন হয় দেশের বাইরে থেকে কাজ আনা। বিদেশি কাজ আনার জন্য যদি আলাদা কোনো প্রতিষ্ঠান কাজ করে তাহলে বিপিও খাতে কাজ আরও বেড়ে যাবে। এই জায়গাতে কাজের সুবর্ণ সুযোগ রয়েছে এবং প্রচুর লোকবল নতুন করে কর্মসংস্থান পাবে বলে মনে করি।’
বিদেশি কাজ পেতে হলে আর কী করা যেতে পারে? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘দেশীয় মার্কেটের যে কাজ আমরা পাচ্ছি তা দিয়ে এ খাত বেশি দূর আগাতে পারবে না। বিদেশি কাজ পেতে হলে ঐ জায়গাগুলোতে অ্যাওয়ারনেস বৃদ্ধি করতে হবে। যাতে করে বহি:বিশ্ব জানতে পারে যে, বাংলাদেশ তাদের কাজ করে দেওয়ার স্বক্ষমতা রাখে।’
বিপিও খাতে আগামি ২০২৫ সালের মধ্যে ১ লাখ লোকের কর্মসংস্থান ও আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ৫ বিলিয়ন ডলার। এই লক্ষ্যমাত্রাকে সামনে নিয়ে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কলসেন্টার অ্যান্ড আউটসোর্সিং (বাক্কো) দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছে।
দেশে ১৭০টিরও বেশি প্রতিষ্ঠান বাক্কের তালিকাভুক্ত। বর্তমানে এ খাতে ৬০ হাজার লোকবল কাজ করছে। মাই আউটসোর্সিং বিডিতে আপাতত ৪’শ কর্মী কাজ করছে। প্রতিষ্ঠানটি প্রতিবন্ধীদেরও কাজের সুযোগ করে দিয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে। এ বিষয়ে তানজিরুল বাসার বলেন,‘প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করতে আমাদের কোনো সমস্যা হচ্ছে না, বরং তাদের থেকে আমরা আরও বেটার আউটপুট পেয়ে থাকি। আমাদের ঢাকা অফিসগুলোর পাশাপাশি যশোরের অফিসেও প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করার প্রচেষ্টা চলমান রয়েছে। খুব শীঘ্রই এ খাতে আরও কিছু প্রতিবন্ধীদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারবো ইনশাল্লাহ।’
প্রতিবন্ধীদের নিয়ে কি ধরনের কাজ করানো যায়? এমন প্রশ্নের জবাবে তানজিরুল বাসার বলেন, ‘প্রতিবন্ধীদের দিয়ে মূলত; কলসেন্টারে কাজ করিয়ে থাকি। যারা শ্রবণ ও বাক প্রতিবন্ধী তাদের দিয়ে ডাটা এন্ট্রির কাজ করিয়ে থাকি। একজন স্বাভাবিক মানুষের তুলনায় একজন প্রতিবন্ধীর কাছ থেকে এ বিষয়ে বেশি আউটপুট পেয়ে থাকি।’
কল সেন্টারের দীর্ঘ পথ চলায় কাজের প্রতিবন্ধকতা সম্পর্কে জানতে চাইলে বাসার বলেন,‘আমাদের বড় প্রতিবন্ধকতা হলো- কতিপয় প্রতিষ্ঠান আন্ডার রেটে ক্লায়েন্টদের সার্ভিস দেওয়ার চেষ্টা করছে। এতে করে ঐ প্রতিষ্ঠানটি সেবার মান ঠিক রাখতে তো পারছেই না বরং ক্লায়েন্টকে হারাচ্ছে ও তার মনে ইন্ডাস্ট্রির কাজের মান নিয়ে বাজে একটি অভিজ্ঞতা জোগাচ্ছে যা আমাদের বিপিও খাতকে হুমকির মুখে ফেলছে।’
দেশের বিপিও খাত বর্তমানে পার্শবর্তী রাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে বলেও জানান বাসার। তিনি আরও জানান, বাংলাদেশের বিপিও খাত অনেকগুলো দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করছে। এ খাতের অনেকগুলো শাখা রয়েছে। এক একটি সেবা নিয়ে এক এক দেশের সঙ্গে প্রতিযোগিতা হচ্ছে। যেমন- ভয়েস এর দিক দিয়ে নর্থ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া ও ফিলিপিনের সঙ্গে প্রতিযোগিতা চলছে। যদিও এ রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশের চেয়ে অনেক বছর আগে তাদের কার্যক্রম চালু করেছে।
দেশের বিপিও খাতে প্রতিবছর কয়েক হাজার লোকের কর্মসংস্থান তৈরি হয়। মাই আউটসোর্সিং লি.-এ কী পরিমান লোকবল প্রতিবছর যুক্ত হয়? যারা নতুন যুক্ত হচ্ছেন তাদের যোগ্যতা ও বেতনসীমা সম্পর্কে জানতে চাইলে তানজিবুল বাসার বলেন, প্রতিবছর এ প্রতিষ্ঠানে প্রায় ২’শ থেকে ৩’শ লোকবলের কর্মসংস্থান হয়। এই পেশায় একজন কর্মী একাধারে অনেকগুলো দক্ষতা অর্জন করতে পারে, যা অন্য শিল্পে সম্ভাব না । কমিউনিকেশন স্কিল, সেলস স্কিল, লিডারশিপ স্কিল বৃদ্ধির পাশাপাশি এখানে একজন কর্মী পাচ্ছেন চমৎকার কর্মপরিবেশ, এছাড়া পড়াশোনার পাশাপাশি পার্ট-টাইম কাজ করে উপার্জন করারও সুযোগ থাকছে। শুধু পেশা হিসেবে নয়, উদ্যোক্তা হিসেবে ও রয়েছে অপার সম্ভাবনা এই শিল্পে। একজন ফ্রেশার এ খাতে যুক্ত হয়েই গড়ে ১০হাজার টাকা আয় করতে পারছে। তাদের স্কিলড বাড়তে থাকলে বেতনও বাড়তে থাকে, এক পর্যায়ে গিয়ে তারা ২৫ থেকে ৩০ হাজার টাকা আয় করার সুযোগ পান।
উল্লেখ্য, মাই আউটসোর্সিং লিমিটেড অ্যাপোলো হসপিটাল, ইউনাইটেড হসপিটাল, স্কয়ার হসপিটালসহ দেশের অনেকগুলো হসপিটালের কলসেন্টার সার্ভিস ও অ্যাপয়েন্টমেন্ট সার্ভিস দিয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। এছাড়াও দেশের সকল থানায় এ প্রতিষ্ঠানটির সিস্টেম চলমান রয়েছে। জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ ও এ প্রতিষ্ঠানের ডেভেলপ করা সিস্টেম।