আমার বিদেশ ভ্রমনের শুরুর ঘটনাটি ছিলো বেশ মজার। সম্ভবত ২০০৮ সাল। আমার পরিচালনায় ‘নোয়াখালী ওয়েব’ দেশে বিদেশে ব্যাপক জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। সাধারণ পাঠক ছাড়াও সমাজের উঁচু স্তরের মানুষের কাছেও সমাদৃত হতে থাকে। সে সুবাধে পরিচয় ঘটে এক সময়ের দেশের শীর্ষ গডফাদার ও তিন বারের সাবেক এমপি এবং বর্তমানে আওয়ামীলীগের উপদেষ্টা জয়নাল হাজারীর সাথে। গডফাদার হলেও নানান কারণে আমি তাকে পছন্দও করতাম। তিনি তখন কলকাতায় নির্বাসিত জীবন যাপন করছেন। সে সময় তিনি হাজারিকাডটকম নামের একটি অনলাইনের মাধ্যমে নিজের বিভিন্ন বিষয়, আত্মজীবনী তুলে ধরতেন। আমি তার নিয়মিত পাঠকও বটে। একদিন কথা প্রসঙ্গে তিনি বললেন কলকাতা বেড়াতে আস। আমার সাইটটির কারিগরী উন্নয়ন বিষয়ে পরামর্শ দাও কিভাবে করলে আরো ভালো হবে।
মূলত তার আমন্ত্রণেই কলকাতা যাওয়ার পরিকল্পনা করি। তখন ঢাকায় ইন্ডিয়ার একটি মাত্র ভিসা সেন্টার ছিলো গুলশান-১। প্রথমদিন যখন গেলাম জমা দেয়ার সময় শেষ। দ্বিতীয়দিন যখন গেলাম সিরিয়াল কাভার করলো না। উল্লেখ্য, তখন সিরিয়াল এর লাইন পুলিশ প্লাজার সাথের ব্রীজ পেরিয়ে যেত। তৃতীয়দিন আমার তৎকালীন স্টাফ মোস্তাফিজসহ ফজরের আজানের সাথে সাথে বেরিয়ে পড়লাম। সিএনজি ছাড়া বিকল্প কোন যানবাহন ছিলো না। নভেম্বর মাস বেশ কুয়াশাচ্ছন্ন। সিএনজি যখন সাত রাস্তার মোড় যায় দাঁড়িয়ে থাকা একটি ট্রাকের উপর আঁচড়ে পড়ে। সামনের গ্লাস ফ্রেম ভেঙ্গে পেছনে এসে পড়ে। কপালে এবং হাঁটুতে প্রচন্ড আঘাত পাই। মাথা চক্কর দিয়ে উঠে। আশপাশের মানুষজন এবং ডিউটিরত পুলিশ আমাদের প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়। সিএনজি ট্রাকের কর্ণারে লাগছে বলেই প্রাণে রক্ষা, যদি সোজাসুজি লাগতো সেদিনই স্পট ডেড হওয়ার সম্ভাবনা ছিলো! পরে পুলিশের সহযোগিতায় একটি রানিং মাইক্রোতে ভিসা সেন্টার পোঁছি। ততক্ষণে অনেক দেরী হয়ে গেছে। লাইন গড়িয়েছে ব্রীজ পর্যন্ত। দেখলাম আজও কোন উপায় নেই। তখন সিরিয়াল বিক্রি হতো ৮০০-১০০০ টাকা করে। দুর্ঘটনার কথা বলাতে এক দালাল এর দয়া হলো। সে ৫০০ টাকায় সিরিয়াল বিক্রি করতে সম্মত হলো। অবশেষে সেদিন ভিসার আবেদন জমা দিলাম এবং নির্ধারিত দিনে ভিসা ডেলিভারি পেলাম।
কলকাতা যাওয়ার প্রস্তুতি হিসাবে গ্রীনলাইন বাসের টিকেট কাটলাম। সোনালী ব্যাংক থেকে ডলার এন্ড্রোস করলাম এবং ট্রাভেল ট্যাক্স পরিশোধ করলাম। তখন ট্রাভেল ট্যাক্স ছিলো ৩০০ টাকা। নির্ধারিত দিন সকাল ৭ টায় গাড়ী ছাড়লো রাজারবাগ থেকে। জীবনের প্রথম বিদেশ ভ্রমন। বেশ পুলকিত। তবে একা হওয়ায় কিছুটা বোরিং লাগছিল। চিরাচরিত স্বভাব হিসাবে পাশের লোকের সাথে খাতির জমিয়ে নিলাম। তাই খুববেশি খারাপ লাগছিলো না। আরিচা ঘাটে সেদিন প্রচন্ড জ্যাম। গতরাতের বাস পার হতে পারেনি তখনো। খবর পেয়ে আমাদের ড্রাইভার বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিলো। যমুনা ব্রীজ তথা সিরাজগঞ্জ হয়ে বিকল্প রুটে চলে গেলো। এ রুটে দূরত্ব বেশি তারপরও এটিই ছিলো উত্তম সিদ্ধান্ত। বেনাপোল যখন পোঁছি ঘড়ির কাটা ৫টা ছুঁইছুঁই। গতরাতে ছেড়ে আসা বাসগুলোও পোঁছে আমাদের পরপর। ৬ টায় ইমিগ্রেশন বন্ধ তাই কিছুটা দুঃচিন্তা ছিলো। শেষ পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাকভাবেই সম্পন্ন হয়। ইন্ডিয়া সাইডের রাস্তাটি তখন খুবই খারাপ ছিলো। প্রায় ৪ ঘন্টা জার্নি শেষে রাত সাড়ে নয়টার সময় দমদম পোঁছি। গাড়ি থেকে নেমেই পাশের একটি দোকান থেকে হাজারী ভাইকে ফোন করি। তিনি তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা দেবু দত্ত কে পাঠান। সে আমাকে নির্দিষ্ট পয়েন্ট থেকে রিসিভ করে নিয়ে যায়। বাসায় পোঁছতেই আন্তরিক অভিবাদন। উনার সাথে ইতোপূর্বে আমার কখনো দেখা না হওয়ায় অনুভূতিটা ছিলো অন্যরকম। বার বার ভাবছিলাম এই সেই গডফাদার! যাই হোক রাতের খাওয়া দাওয়া সেরে সেদিনের মত ট্যুর এর সমাপ্তি ঘটলো।
কলকাতায় হাজারীর আয়েশী ও রুটিন মাফিক জীবন। সকালে ঘুম থেকে উঠে ব্যায়াম দিয়ে শুরু এবং রাতের খাবার দিয়ে শেষ। নিজস্ব ফ্ল্যাট, ২টা গাড়ী, বেশ কয়েকজন স্টাফ। কম্পিউটার অপারেটর/নিউজ আপলোড়ার ওয়াসিম লস্কর! পরেরদিনই তার সাথে খাতির জমে উঠে। সম্ভবত ৩/৪ দিন ছিলাম। এ সময় দেবু আমাকে গাড়ী দিয়ে পুরো শহরটা মোটামুটি ঘুরিয়ে দেখায়। যদিও কোন দর্শনীয় স্থানে তখন যাওয়া হয়নি। তবে ‘নোয়াখালী সম্মীলনী’র তৎকালীন সভাপতি মন্টু সাহার অফিসে গিয়েছিলাম। প্রচন্ড ব্যস্ত মানুষ তারপরও সময় দিয়েছেন, আন্তরিকতার সাথে গল্প করেছেন এবং চা বিস্কুট এর আপ্যায়নও ছিলো। দেবু ছাড়া ওয়াসিম এর সাথেও একদিন ঘুরতে বের হয়েছিলাম। ভাঙর নামক এক গ্রামে গিয়েছিলাম তার এক বান্ধবীর বাড়ীতে। যেখানে বাইক ছাড়া বিকল্প বাহন নেই তাই যাওয়ার পথে কয়েক কিলোমিটার হেঁটে যেতে হয়েছে। আসার সময় অবশ্য একজন বাইকে পোঁছে দেয়। হাজারীর ওখানে সবকিছুই ছিলো আরামদায়ক। তার অতিথেয়তায় কোন ঘাটতি ছিলো না। এমনকি কেনাকাটার জন্য কিছু টাকাও দিয়েছিলেন। তবে তার ২ বিলাতি কুকুর টগি-ডগি ছিলো বিরক্তির কারণ! আমি কুকুর এর সাথে চলাফেরায় অভ্যস্ত ছিলাম না, তাই তাদের খোঁচাখুঁচি আমার সফর সংক্ষিপ্ত করতে বাধ্য করে। মূলত যে উদ্দেশ্যে যাওয়া অর্থাৎ ওয়েবসাইট উন্নয়ন সেটি নিয়েও আলাপ আলোচনা হয়। এ সময় হাজারীর একটি সাক্ষাৎকারও প্রকাশ করেছিলাম ‘নোয়াখালী ওয়েব’ এ যেটি দেশ বিদেশে ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিলো।
তখনো আমার কোন ক্যামেরা ফোন ছিলো না। সাথে ক্যামেরাও ছিলো না। ফলে প্রথম ভ্রমনের কোন ছবি আমার কাছে নেই। সাক্ষাৎকার গ্রহণের ছবিটিও তোলা হয়েছিলো ওয়েব ক্যামেরায়। এদিকে ফেরার দিনের স্মৃতিটুকু খুব একটা মনে নেই তবে মনে আছে ফিরেছিলাম সোহাগ পরিবহন এর গাড়ীতে।
লেখক: সম্পাদক, দৈনিক ডিজিটাল সময়।