পানিবণ্টন চুক্তি গুরুত্ব পাক

digitalsomoy

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের ভারত সফর বিশেষত দুটি কারণে গুরুত্ব বহন করে। একটি হচ্ছে, দৃশ্যমানতার দিক থেকে অর্থাৎ নরেন্দ্র মোদি ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার পরে আমাদের সরকারপ্রধান এবারই প্রথম দ্বিপাক্ষিক সফর করছেন। তিনি যদিও এর আগে নরেন্দ্র মোদির অভিষেক অনুষ্ঠানের সময় দিল্লি গিয়েছিলেন; কিন্তু দ্বিপাক্ষিক হিসাবে এ সফর দৃশ্যমানতার দিক থেকে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। দ্বিতীয় ব্যাপার হচ্ছে, আমাদের প্রধানমন্ত্রীও নতুন সরকার গঠনের পর প্রথম যাচ্ছেন। কাজেই সেই জায়গায় দুই দেশের সরকারপ্রধানের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কটাকে সামনে তুলে ধরার জন্য এ সফরটা বেশ গুরুত্ব বহন করে বলে আমি মনে করি।

বাংলাদেশ-ভারত দুটি নিকট প্রতিবেশী দেশ হিসাবে আমাদের মধ্যে বহুমাত্রিক সম্পর্ক রয়েছে; সেই সুবাদে দুই দেশেরই বেশকিছু বিষয় রয়েছে। পারস্পরিক গুরুত্ব দিয়ে তারা সেই বিষয়গুলো উপস্থাপন করেন, ঐকমত্যে পৌঁছাবার জন্য চেষ্টা করেন। প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফরেও ভারতের পক্ষ থেকে যেমন কিছু বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া হবে, আমাদের দিক থেকেও কিছু গুরুত্বের বিষয় রয়েছে। ভারতের দিক থেকে যেমন নিরাপত্তার দিকটি দুই দেশের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। এ বিষয়টিকে গুরুত্বের মধ্যে রাখার জন্য দু’দেশই সহমত পোষণ করবে। সে ক্ষেত্রে আমার ধারণা, ভারতের দিক থেকে দিল্লি হয়তো বলবে, সামরিক সরঞ্জাম সংগ্রহের জন্য তারা আমাদের পাঁচশ মিলিয়ন ডলার যে ঋণ দিয়েছিল, সেই ঋণটা ব্যবহার হোক। এ ব্যাপারে তারা তাদের দিক থেকে আগ্রহ প্রকাশ করতে পারে। এ ছাড়া অন্যান্য নিরাপত্তার বিষয়গুলো যেমন সন্ত্রাসবিরোধী অবস্থান নিয়েও তারা মতামত প্রকাশ করতে পারে। এ ক্ষেত্রে আমাদের দিক থেকেও যেহেতু পারস্পরিকতা আছে, সেখানে এ বিষয়গুলো নিয়ে সহমত প্রকাশের ক্ষেত্রে কোনো অসুবিধা আছে বলে আমি মনে করি না।

অর্থনৈতিক দিক থেকেও ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক এগিয়ে যাচ্ছে, গভীর হচ্ছে; একথা তো আমরা জানি। এ গভীরতার চেহারাটা কেমন, সেদিকে যদি আলোকপাত করি, তাহলে বলতে হয়, দুদিক থেকেই সম্পর্ক বিস্তৃত হচ্ছে। এটা ইতিবাচক; কিন্তু যদি অন্য বিষয়গুলোর ব্যাপারে দেখি, তাহলে বলতে হয়, ভারত-বাংলাদেশের বাণিজ্যিক সম্পর্কে রপ্তানির দিক থেকে আমরা এখনো আশানুরূপ ফল পাইনি। অর্থাৎ যে পরিমাণ রপ্তানি করার কথা ছিল, তা করতে পারছি না। সে ক্ষেত্রে যেমন আমাদের দিক থেকে রপ্তানিযোগ্য পণ্যের যথেষ্ট ঘাটতি আছে, একইভাবে ভারতের দিক থেকেও কিন্তু এখনো অশুল্ক এবং আধাশুল্ক প্রতিবন্ধকতাটি আছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ২০১৭ সাল থেকেই কিন্তু এ অশুল্ক কিংবা আধাশুল্কের বাধা সরানোর জন্য বারবার অনুরোধ করছেন; কিন্তু তারপরও এ বাধাগুলো রয়েই গেছে। ফলে আমরা ভারতের বাজারে যে পরিমাণ রপ্তানি করার কথা, তা পারছি না। এছাড়া রপ্তানিযোগ্য পণ্য বাড়াবার ক্ষেত্রেও ভারতের দিক থেকে যে বিনিয়োগ সহযোগিতা করা দরকার, সেটিও যথেষ্ট পরিমাণে আসছে না। সে কারণেই আমরা তাদের দুটি ইকোনমিক জোন দেওয়ার পরও এখানে তাদের বিনিয়োগ খুব বেশি হয়েছে বলে আমার মনে হয়নি। এ ক্ষেত্রে আমাদের বাণিজ্যিক সম্পর্কটাকে বা ব্যবসা-বাণিজ্যটাকে সুষম করার জন্য ভারতের দিক থেকে কিছু উদ্যোগের প্রয়োজন রয়েছে; যাতে অশুল্ক বা আধাশুল্ক বাধাগুলো দূর করা যায়। ভারতের বিনিয়োগ যদি বাড়ে, তাহলে তারা এখানে বেশি পণ্য তৈরি করে ভারতে রপ্তানি করতে পারবে, এতে আমাদের মুনাফাও হবে। আমার ধারণা, আমাদের দিক থেকে এ বিষয়গুলো দাবি হিসাবে থাকবে এবং ভারতও এ বিষয়গুলো গুরুত্বের সঙ্গে নিশ্চয়ই বিবেচনা করবে। এছাড়া ইকোনমিক পার্টনারশিপ নিয়েও দীর্ঘদিন ধরে আলাপ-আলোচনা হচ্ছে। ভারতের দিক থেকে তারা এ ব্যাপারে বিশেষভাবে আগ্রহীও। ইতোমধ্যে বলা হচ্ছে, এতে দু’দেশই উপকৃত হবে। আমিও সেটা মনে করি; কিন্তু সেটায় উপকৃত হওয়ার জন্য বাংলাদেশের দিক থেকে যে প্রস্তুতিগুলো থাকা দরকার, সেই প্রস্তুতিগুলো কতটা আছে, সেটা এখনো আমি জানি না। কিন্তু এ বিষয়টিতে আমার ধারণা দু’দেশের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ই হয়তো ইতিবাচক সম্মতি দেবে এবং সেটা দিলে আমার ধারণা বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্কটা আরও বিস্তৃত হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে।

আরেকটি বিষয় আমাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যেটা ভারতের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ; কিন্তু সেটিতে তারা খুব বেশি মনোযোগ দেয় না। সেটা হচ্ছে পানিবণ্টন। তিস্তা নদীর পানিবণ্টনের বিষয়টি অনেকদিন ধরেই ঝুলে আছে। আমরা বেশ জোরের সঙ্গেই বলব, তিস্তা চুক্তিটা সম্পাদিত হোক। এটা আমাদের দাবি হিসাবে থাকবে; কিন্তু এর সঙ্গে এ বিষয়টিতেও আমি সতর্ক করছি, ভারতের সাম্প্রতিক রাজনৈতিক বিন্যাস যেভাবে তৈরি হয়েছে, তাতে এ বিষয়টিতে আমরা আশা রাখলেও খুব বেশি আশাবাদী হওয়ার মতো জায়গা আমি দেখছি না। তবে আমাদের দিক থেকে বলে যেতে হবে। আসলে ভারতের রাজনৈতিক সদিচ্ছা যদি থাকে, তাহলে এটা সমাধান করা অসম্ভব নয়। কেন নয় সেটাও বলছি। ২০১৫ সালে যখন আমরা ‘স্থলসীমান্ত’ চূড়ান্ত করি এবং নরেন্দ্র মোদি ঢাকায় এসে তাতে স্বাক্ষর করেন, তখন কিন্তু ভারতীয় পার্লামেন্টের সব দল-মত-নির্বিশেষে ঐকমত্যের ভিত্তিতে তাকে (নরেন্দ্র মোদি) অথরাইজড করেছিল এ চুক্তি করার জন্য। এর অর্থ হচ্ছে, তখন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি নিজে এটার নেতৃত্ব নিয়েছিলেন। তখন আসাম ও পশ্চিমবঙ্গের কিছু বিরোধিতা সত্ত্বেও সেই চুক্তি বাস্তবায়ন করা গিয়েছিল। কাজেই আমরা আশা করতে চাই, স্থলসীমান্ত চুক্তির সময়ে যে ধরনের রাজনৈতিক নেতৃত্বের বলিষ্ঠতা আমরা দেখেছি, সে রকম বলিষ্ঠতা নিয়েই তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন হোক।

তিস্তা ছাড়াও ভারতের সঙ্গে আমাদের অন্য ৬টি নদী নিয়েও কিন্তু অগ্রগতির কথাবার্তা চলছে। যদিও দুই বছর ধরে জেআরসি (যৌথ নদী কমিশন) বসছে না। কাজেই প্রতিবছর জেআরসি বসে এ বিষয়গুলো নিয়ে দ্রুত কাজ করুক, এ নদীগুলোর পানিবণ্টন ব্যবস্থাপনা নিয়ে তারা দ্রুত সমাধানমুখী কিছু পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে আসুক, এটা আমরা প্রত্যাশা করি। এদিকে ২০২৬ সালে আমাদের ‘গঙ্গা চুক্তি’ও শেষ হয়ে যাবে। কাজেই তখন নবায়নের একটি প্রশ্ন আসবে। আমি জানি না, এবার তারা নীতিগত কোনো অবস্থান ঘোষণা করবেন কিনা; কিন্তু বাংলাদেশের দিক থেকে নিশ্চয়ই আমরা বিষয়টি তাদের দৃষ্টিতে আনতে পারি। সে ক্ষেত্রে জেআরসি হয়তো বসে একটা রিকমেন্ডেশন দিতে পারে, যার মধ্য দিয়ে আমরা হয়তো এটা আবার ত্রিশ বছরের জন্য নবায়িত হোক বা পার্মানেন্টলি এ চুক্তিটা নবায়িত হয়ে যাক, এরকম একটা দাবি হয়তো আমরা ভারতের কাছে তুলতে পারি। এটা কতটা গ্রহণযোগ্য হবে বা ভারত এ মুহূর্তে এটা নিয়ে আলোচনার কতটা গভীরে যাবে আমি জানি না, তবে আমাদের দিক থেকে এ আলোচনাটা চালু রাখা বা উত্থাপন করাটা দরকার বলে আমি মনে করি।

আরেকটি বিষয়ও আমাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ, সেটা হলো ভারত থেকে এখনো আমরা বিদ্যুৎ আমদানি করি। আমি মনে করি, এখানেও আমাদের ডাইভারসিফিকেশনের দরকার আছে। ইতোমধ্যেই আমাদের মন্ত্রিসভা সিদ্ধান্ত নিয়েছে, নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানি করবে। এ আমদানিটা ভারতের মধ্য দিয়ে আসবে; যেহেতু, ভারত এটাকে ত্বরান্বিত করার ক্ষেত্রে উদ্যোগ গ্রহণ করুক তা চাইব। শুধু নেপাল নয়, ভুটান থেকেও যাতে আমরা বিদ্যুৎ আমদানি করতে পারি, সে ব্যাপারে ভারতের সহযোগিতা আমরা চাইব। কাজেই জ্বালানি ক্ষেত্রেও আমি মনে করি, এবারের সফরে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত আসা উচিত বা আসার মতো সুযোগ এখন তৈরি হয়েছে।

আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা ইস্যু নিয়ে আমরা জেরবার হচ্ছি। এখন সে দেশে অভ্যন্তরীণ সংঘাত চলছে, সেই সংকটের প্রেক্ষাপটে আরও রোহিঙ্গা এখানে যোগ হয়েছে। সে ক্ষেত্রে এটি বাংলাদেশের জন্য যেমন সংকট, ভারতের জন্যও তেমনি সংকট। কাজেই এক্ষেত্রে আমরা উভয়পক্ষ মিয়ানমারের বাস্তবতাটাকে কীভাবে ম্যানেজ করা যায়, সে ব্যাপারে পারস্পরিক সহযোগিতা করা উচিত। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের একটি বিষয় স্পষ্ট করা দরকার হতে পারে। তা হলো, ভারতের এখানে চীনের সঙ্গে সম্পর্কের আলোকে বাংলাদেশকে ব্যাখ্যা করার একটি প্রবণতা কিন্তু আছে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্পষ্ট অবস্থান প্রকাশ করতে হবে, ভারতের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের কাঠামো ও চীনের সঙ্গে আমাদের সম্পর্কের কাঠামো একদমই ভিন্ন। আমরা দ্বিপাক্ষিকভাবে প্রয়োজনের তাগিদে ভিন্ন ফ্রেমের মধ্যে বা ভিন্ন পরিকাঠামোর মধ্যে সে সম্পর্কটাকে পরিচালনা করি। কাজেই এখানে ভারত-চীন সম্পর্কের মধ্যে আমাদের ঢুকবার কোনো প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশের দিক থেকে এটা স্পষ্ট করে বলা দরকার, দিল্লির সঙ্গে সম্পর্ক রাখতে গিয়ে চীন-ভারত সম্পর্কের মধ্যে আমরা জড়াব না। এবং ভারতকে বাংলাদেশ আশ্বস্ত করতে পারে, ভারতের স্বার্থে কোনো ধরনের হানি এখানে ঘটবে না। এভাবে চীনের ক্ষেত্রেও আমরা বলতে পারি, বেইজিংয়ের সঙ্গে ঢাকার দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক রাখার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে সম্পর্ক বজায় রাখবে। এ ক্ষেত্রে তৃতীয় কোনো পক্ষের হয়ে ঢাকা কাজ করবে না। এ নিশ্চয়তাটা আমার মনে হয় বাংলাদেশের দিক থেকে স্পষ্ট করা দরকার। কারণ, এখন পৃথিবীর যে বাস্তবতা, সেখানে ভারত-চীন সংঘাতের মধ্যে আমাদের জড়িয়ে পড়ার একটা আশঙ্কা থাকবে। আবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে সম্পর্কের যে টানাপোড়েন, সেখানেও আমাদের জড়িয়ে পড়ার একটা আশঙ্কা কিন্তু থাকছে। সেই প্রেক্ষাপটেই আমাদের এ বিষয়টি স্পষ্ট করা দরকার, আমরা প্রত্যেকের স্বার্থে আমাদের প্রয়োজনের ভিত্তিতে দ্বিপাক্ষিকভাবে আমরা সম্পর্ক বজায় রাখতে আগ্রহী। তাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের মধ্যে ঢুকতে আমাদের কোনো আগ্রহ নেই।

এম হুমায়ুন কবির : সাবেক কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক