চৈত্রের শেষে

digitalsomoy

হিমেল রোজারিও

আজ চৈত্রের শেষ। মাঠ-ঘাট, খাল-বিল ফেটে চৌচির হয়ে আছে। চারদিকে পানির জন্য হাহাকার। কৃষক বৃষ্টির অপেক্ষায় র্তীথের কাকের মতো আকাশপানে চেয়ে আছে। বৃষ্টির পরই মাঠে নতুন ফসল বুনবে।

আকাশের ঈশান কোনে মেঘ জমেছে। আজ মনে হয় বৃষ্টি হবে। গ্রামের বটতলার মাঠে আজ চৈত্র সংক্রান্তি মেলা বসেছে। দূর-দূরান্ত থেকে মানুষ আসছে মেলায়। কবে থেকে এই মেলা বসছে তা কেউ এই বিষয়ে কিছু ঠিক মতো বলতে পারে না।

নিপেন বুড়োকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম কিন্তু মেলার ইতিহাস বিষয়ে কোনো উত্তর মেলেনি। নিপেনের ছোট ভাই অনিমেশ কাকা কলকতায় পড়াশোনা করেছে। প্রায় ২২বছর পরে এই বাংলায় এসেছে। বাবা-মায়ের সাথে রাগ করে বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিল। অবশেষে অনিমেশ কাকার মাধ্যমে জানতে পারলাম এই মেলার ইতিহাস।

অনিমেশের দাদু উপেন্দ্র চৌধুরী। গ্রামের মানুষের মধ্যে ভাতৃত্ব তৈরি করার জন্য বিরানব্বই বছর আছে হিন্দু কৃষকদের একত্রিত করার উদ্দেশ্যে। চৈত্রের শেষ দিন সবাই একত্রিত হতো। নিজেরদের মধ্যে কোন বিভেদ সৃষ্টি করা যাবে না। আমরা একত্রিত থেকে এই গ্রামকে একটি আদর্শ গ্রাম হিসেবে গড়ে তুলতে চাই।

আমাদের মধ্যে যেন অন্যরা কোনো দুর্বলতার সুযোগ নিতে না পারে। কোনো ক্ষতি যেন কেউ করতে না পারে। উপেন্দ্র চৌধুরীর কথা সবাই মনোযোগ দিয়ে শোনে। সেদিন কথা শেষ হবার পর মাঠের চৈতালি ফসলের ভালো ফলনের জন্য ভগবানকে ধন্যবাদ জানানোর জন্য এক পূজার আয়োজন করতো। সেই বছর শুধু এই গ্রামের মানুষ একত্রিত হয়েছিল। এর পর থেকে প্রতিবছর গ্রামের কৃষকদের একত্রিত করার জন্য চৈত্রের শেষ দিন ভাগবানের উদ্দেশ্যে পূজার আয়োজন করা হয়ে আসছিলো।

আজো তার ব্যতিক্রম নয়। আজ শুধু এই ভবানীপুর গ্রামের মানুষ নয়। আরো পনের-বিশটি গ্রামের মানুষ একত্রিত হয়েছে। সন্দেশ, জিলাপী, বাতাসা, খাগরাই, মুড়কিসহ বিভিন্ন ধরনের সুস্বাদু খাবারের দোকান বসেছে। মেলা খুব ভালো জমে উঠছে। ঈশান কোনের মেঘ আরো বেশি ঘন কালো রূপ ধারণ করছে। কখন যেন নেমে পড়ে কাল বৈশাখী ঝড়। তাই অনেকে মেলার কেনাকাটা শেষ করে বাড়ির দিকে রওনা রয়েছে। অনেকে ফিরে যেতে পারেনি। তখনি শুরু হয়ে গেলে ঝড়।

ঝড়ে সব কিছু লণ্ড-ভণ্ড হয়ে যাচ্ছে। যে যার মতো ছুটছে। ঝড়ের সাথে প্রচণ্ড বৃষ্টি। চৈত্রের খড়ার পরে এক ফোটা বৃষ্টি যেন মাটিকে নতুন জীবন দিচ্ছে। ধুলোগুলো ধীরে ধীরে হারিয়ে যাচ্ছে। চারদিকে ধীরে ধীরে অন্ধকার তার রাজ্য বিস্তার করে চলছে। ঝড়ের তাণ্ডবে পুরানো বটগাছের একটি মগডাল ভেঙ্গে পড়েছে। চারদিকে শুধু বাতাসের শব্দ।

এই ঝড়-বৃষ্টির মধ্যে বটতলা ছেড়ে যায়নি শুধু অনিমেশ। বৃষ্টিতে কাক ভেজা হয়ে বট গাছের সাথে দেহটা এলিয়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে চোখ বন্ধ করে। চোখ বন্ধ করতেই  অনিমেশ চলে যায় বাইশ বছর আগের শৈশবে। এই মেলায় দেখা হয়েছিল পাশের গ্রামে শ্রুতির সাথে। শ্রুতির সাথে অনেকটা ভালোবাসার বিনিময়ও হয়েছিল। কথাগুলো যতই মনে হচ্ছিল বৃষ্টি ও বাতাসের গতিবেগ আরো বেড়েই যাচ্ছিল। অনিমেশ ভাবছে শ্রুতি আজ কোথায় কার সাথে ঘর করছে তা জানা নেই। ঝড়-বৃষ্টি ও হালকা অন্ধকার নারায়ন একটি হাতের স্পর্শ অনুভব করে।

চোখ মেলতেই দেখে বাইশ বছর আগের হারানো প্রেম শ্রুতি। অন্যদের মতো শ্রুতি বাড়ি যেতে পারেনি। বটগাছের অন্যপাশেই বসে ছিল সে। কে জানতো যে, এই ঝড়ই আজ অনিমেশের হারানো প্রেমকে একত্রিত করবে। কেউ কাউকে চিনতে ভুল করেনি।

অনিমেশ শ্রুতিকে জিজ্ঞাসা করে, এই প্রচণ্ড ঝড়ে তুমি একটি মেয়ে হয়ে এখানে একা আছো, ভয় পাওনি? শ্রুতি উত্তর দেয় যা হারাবার তা তো অনেক আগেই হারিয়ে ফেলেছি। যার কিছু নেই তার হারাবার ভয়ও নেই। চেয়েছিলাম এই ঝড়ের মাঝে নিজেকে শেষ করে দিব।

হালকা অন্ধকারে একজন আরেক জনের মুখ স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে। বৃষ্টিতে শ্রুতির শরীরটা ভিজে কাকের মতো চুপসে গেছে। কিছুক্ষণ দুজনেই নিরব। কোনো কথা নেই দুজনার মধ্যে। আবছা অন্ধকারে একে অন্যের দিকে নির্বাক হয়ে শুধু চেয়ে রইল। হঠাৎ একটা বজ্রপাতের প্রচণ্ড গর্জন হলে শ্রুতি ভয়ে জড়িয়ে ধরে অনিমেশকে।

বজ্রপাতের গর্জনে কল্পনার জগত থেকে বাস্তবতায় ফিরে আসে দুজন। অনিমেশ শ্রুতিকে বলে, আমি আর তোমাকে হারাতে চাই না। দুইজনই তখন মুখের ভাষা হারিয়ে ফেলে। ঘন-কালো অন্ধকার শ্রুতি আর অনিমেশকে আড়াল করে দেয় সমাজ-সংসার-ধর্মের উপরে।

অন্ধকার যতই গভীর হচ্ছে দুইজন দুজনার মধ্যে ততটাই হারিয়ে যাচ্ছে। শ্রুতি অনিমেশকে বাইশ বছর পরে নতুন করে আবিষ্কার করে। শুধু মন্দিরটাকে নয় ধীরে ধীরে অন্ধকার গ্রাস করে নিচ্ছে শ্রুতি ও অনিমেশকে।

লেখক : গল্পকার, কবি ও সাংবাদিক, জাতীয় দৈনিক নতুন সময়।