উদ্যোক্তা লুনা শারমিনের ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প

digitalsomoy

বিপাশা দাশ

প্রতিনিয়ত জীবন সংগ্রাম করে যারা বিভিন্ন দেশীয় পণ্য নিয়ে কাজ করে এগিয়ে যাচ্ছেন তাদের মধ্যে একজন হলেন এফ-কমার্স ব্যবসায়ী লুনা শারমিন। শূন্য থেকে তার এফ-কমার্স ব্যবসায়ী হয়ে উঠার গল্পটা একটু ভিন্ন ধরনের। নানান চড়াই-উৎরাই পেরোনোর।   

ছোটবেলায় বিশেষ কিছু হওয়ার স্বপ্ন না দেখলেও সম্মানজনক কিছু করার ইচ্ছে মনে লালন করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়শোনা শেষ করার পরে সে ইচ্ছের বাস্তবায়ন করেন। বাস্তবতা সেটি থেকেও ভিন্ন কিছু করার তাগিদ দিতে থাকে তাকে। আর চ্যালেঞ্জ নিয়ে শুরুও করেন। এরপর নানান প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে এগিয়ে চলে তার জীবন। শেষে হন এফ-কমার্স ব্যবসায়ী। এখন নিজের একটা আলাদা পরিচয় তৈরি হয়েছে। তিনি এখন উদ্যোক্তা।

নারী উদ্যোক্তাদের জনপ্রিয় ফেসবুক প্লাটফর্ম উইম্যান অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই) গ্রুপের হাত ধরে হাফ মিলিয়নার হয়েছেন ‘কভার লাইফ’ এর স্বত্বাধিকারী আত্মপ্রত্যয়ী উদ্যোক্তা লুনা শারমিন। ডিজিটাল সময়ের পাঠকদের জন্য আত্মপ্রত্যয়ী এই নারীর গল্পটা এখানে তুলে ধরা হলো।

বন্দরনগরী চট্টগ্রাম জেলার সন্দ্বীপে জন্ম লুনা শারমিনের। শৈশবের দিনগুলো সন্দ্বীপে কাটলেও  অর্থনীতিতে অনার্স ও মাস্টার্স পাস করেন সরকারি মহিলা কলেজ থেকে।

শারমিনের পরিবারের অন্য পাঁচটা সদস্য যেমন- মা, বোন, চাচী, কাজিন সবাই চাকরি করতেন। পারিবারিকভাবে সেই ধারা অনুসারে তিনিও ভাবতেন বড় হয়ে কিছু একটা চাকরি করতে হবে। কেননা পরিবারের সব সদস্যরাই পরিবারের প্রতি অবদান রাখছেন। তাই তাকেও এই অবদান রাখার জন্য  কিছু একটা করতে হবে।  

অর্থনীতিতে অনার্স-মাস্টার্স পাস করা আত্মপ্রত্যয়ী শারমিন  স্বাধীনভাবে নিজে থেকে কিছু একটা করার প্রতি মনে তাগিদ অনুভব করছিলেন। ভাবছিলেন নিজের কোন একটা ছোটখাটো প্রতিষ্ঠান বা ব্যবসা থাকলে নিজের মেধা, কঠোর পরিশ্রম, অধ্যবসায় দিয়ে সেটাকে একটা ভাল অবস্থানে নিয়ে দাঁড় করানো যেতো। সেই প্রতিষ্ঠানে স্বাধীনভাবে নিজের মতো করে কাজ করা যেতো।  নিজের একটা আলাদা পরিচয় হতো। নাম, সম্মান সবই নিজের হতো।

সেই ভাবনা থেকে শুরু করেন নিজে থেকে কিছু করার চিন্তা। কী করা যায়। ২০১৯  সালের ১৯ জানুয়ারি।  রাতে বন্ধুদের সাথে মেসেঞ্জারের  চ্যাট গ্রুপে আড্ডা দিচ্ছিলেন। হঠাৎ একটা ফ্রেন্ড বিজনেসের কথা তুললেন। বললেন অনলাইনে ছোট পরিসরে বিজনেস শুরু করলে কেমন হয়? সেই থেকে শারমিনের মাথায় অনলাইনে বিজনেস করার পরিকল্পনা আসে। পার্টনার হিসেবে পান আরেক বন্ধু রুবনা রুমিকে।

দুই বন্ধু মিলে উদ্যোগ নেন অনলাইনে বিছানার চাদর বিক্রি করবেন। এরপরে আস্তে আস্তে বিক্রির অবস্থা ও ক্রেতাদের চাহিদা দেখে আইটেমের সংখ্যা বাড়াবেন। পরিকল্পনা অনুসারে বাস্তবায়নে নেমে যান দুই বন্ধু। ফেসবুকে একটা বিজনেস পেজ খুলেন তারা। নাম দেন ‘CoverLife’। শুরুতে মাত্র ২০টা বিছানার চাদর দিয়ে শুরু করেন তাদের স্বপ্নের যাত্রা।

পরিচিত, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব নিজেদের নেটওয়ার্কের মধ্যে চালাতে থাকেন অনলাইন মার্কেটিং। একটা, দুটা এভাবে বিক্রি হতে থাকে। এগিয়ে যেতে থাকে দুই বন্ধুর স্বপ্ন। ফেসবুকে মার্কেটিং করতে করতে বিজনেস শুরুর এক বছর পর দেখা পান  নারী উদ্যোক্তাদের জনপ্রিয় ফেসবুক প্লাটফর্ম উইম্যান অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই) গ্রুপের। নিয়ে যোগ দেন। গ্রুপের নিয়ম-কানুনগুলো পড়ে সে অনুসারে দিনের পর দিন সময় দিয়ে যান। জানার আগ্রহ বাড়তে থাকে। ই-কমার্স কী, পার্সোনাল ব্র্যান্ডিং কী, এর গুরুত্ব, কীভাবে এই প্লাটফর্মে নারীরা যুদ্ধ করে নিজের পায়ে দাঁড়াচ্ছেন এসব বিষয়গুলো তাকে আরো কৌতুহলী করে তুলে। উইয়ের হাত ধরে দেখা পান তার জীবনের সেরা শিক্ষক সার্চ ইংলিশ গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা এবং ই-ক্যাবের সাবেক প্রেসিডেন্ট শ্রদ্ধেয় রাজিব আহমেদের সাথে। সেই যে তার জানার ও শেখা শুরু হয় আর শেষ হয় না।

উই গ্রুপে দিন-রাত এক করে নিয়মিত সময় দিয়ে পড়ালেখা করার ফলে সংগ্রামী নারীদের জীবন সংগ্রাম দেখে ও পড়ে আরো দ্বিগুণ প্রেরণা জাগে দুই বন্ধুর মনে।  কঠোর পরিশ্রম ও নিরলস অধ্যবসায় দিয়ে এগিয়ে যেতে থাকেন। সিগনেচার প্রোডাক্ট বেডশিট বা বিছানা চাদর দিয়ে শুরু করলেও বড় প্লাটফর্মে এসে প্রশিক্ষণ নিয়ে বিজনেসের পরিধি আরো বাড়ান। আইটেম হিসেবে যোগ করেন  মশারি, বেবি ড্রেস, শাড়ি ও থ্রি পিস। বর্তমানে দেশীয় পণ্য নিয়ে ভাল সাড়া পাচ্ছেন তারা। শুধু উই প্লাটফর্মেই এসব আইটেম বিক্রি করে তারা হাফ মিলিয়নিয়ার হয়েছেন।

সারাদেশের নারী উদ্যোক্তাদের জন্য এমন সুন্দর একটা অনলাইন প্লাটফর্ম তৈরি করার জন্য উই গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা ও  নাসিমা আক্তার নিশাকে জানান তারা অন্তর থেকে ‍কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ।

শারমিনের ভাষ্য, নারী উদ্যোক্তাদের জনপ্রিয় অনলাইন প্লাটফর্ম উইয়ের হাত ধরে উঠে এসেছে দেশীয় পণ্যের হাজারো এফ-কমার্স ব্যবসায়ী এবং উদ্যোক্তা। যারা একাই দেশী পণ্য সেল করে কেউ হচ্ছেন লাখপতি, আবার কেউ বা হচ্ছেন মিলিয়নার।  অন্য সবার মতো আমিও আজ যা হয়েছি সবই  উইয়ের জন্য। এই প্লাটফর্মটি হাজারো নারীর স্বপ্ন পূরণ করে যাচ্ছে। এই স্বপ্ন পূরণে সাহায্য করছেন আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক রাজিব আহমেদ স্যার। উনার গাইডলাইন আর অনুপ্রেরণামূলক পোস্টের কারণে আমরা  এত বেশি সেল করতে পারছি। উনার শিক্ষায় ও দেখানো পথে চলে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি। এর জন্য স্যারের প্রতি রইল আমার অন্তর থেকে কৃতজ্ঞতা ও ধন্যবাদ। দোয়া করি স্যার যেনো দীর্ঘ জীবন লাভ করেন। 

‘কভার লাইফ’ উদ্যোগটাকে নিয়ে অনেক দূর যাওয়া পরিকল্পনা রয়েছে শরমিনের। ‘কভার লাইফ’-এর প্লাফর্মের মাধ্যমে দেশীয় পণ্যকে সারা দেশের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে চান তিনি।  এই যাত্রাপথে সবার দোয়া চেয়েছেন তিনি।

লেখক : নারী উদ্যোক্তা, ফাউন্ডার ও স্বত্বাধিকারী, অনলাইন প্লাটফর্ম ‘রমনীয়’।