বাংলাদেশ ব্যাংক কেন সাংবাদিকদের ভয় পায়

digitalsomoy

২০১৫ সালে ঢাকায় এসে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন এক গণবক্তৃতায় বলেছিলেন যে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা থাকলে দেশে দুর্ভিক্ষ হয় না। প্রথমত, দুর্ভিক্ষ মানেই খাদ্যশস্যের কম উৎপাদন নয়। সমস্যা থাকে এর বণ্টনে। এই সমস্যাগুলো সাংবাদিকেরা তুলে ধরলে সরকারের পক্ষে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হয়।

দ্বিতীয়ত, ওই সময় মজুতদারি বেড়ে যায়, যা সরকারি নজরদারিতে প্রায়ই আসে না। একমাত্র সাংবাদিকেরা গণমানুষের পক্ষে থেকে এসব মজুতদার বা সিন্ডিকেটের বিষয়ে মানুষকে অবহিত করে থাকেন, যা সরকারকে দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষের দুর্দশা কমাতে সাহায্য করে।

তৃতীয়ত, অনেক সাংবাদিক অনুসন্ধান ও গবেষণাধর্মী কাজের মাধ্যমে অনেক আগে থেকেই সরকারকে সতর্ক করে দিতে পারেন দুর্ভিক্ষের আগাম বার্তা দিয়ে। সে জন্য সাংবাদিকেরা কখনোই সরকারের প্রতিপক্ষ নন। বরং রাষ্ট্রীয় যেকোনো প্রতিষ্ঠানে অবাধ সাংবাদিকতা নিশ্চিত করলে তা দীর্ঘ মেয়াদে সরকারেরই মঙ্গল ডেকে আনে।

অর্থনৈতিক সংবাদের একটি বড় অংশ আসে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে। এগুলো বন্ধ হয়ে গেলে দেশের অর্থনীতির সংকট কোথায় ঘনীভূত হচ্ছে, বোঝা যাবে না। বিপর্যয় উপস্থিত হবে ভূমিকম্পের মতো।

ইদানীং কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে বড়ই অস্থিরতার পরিচয় দিচ্ছে। আজ এক নিয়ম করে চাপের মুখে পড়ে, কাল সুর পাল্টায়—যা দুর্বল ও অপ্রস্তুত নেতৃত্বের পরিচায়ক।

আমার এই লেখার মূল উদ্দেশ্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আসল অসুখের অনুসন্ধান। তাদের আসল সমস্যা কোনো অর্থনৈতিক সংকটের গভীরে না গিয়ে রাতারাতি ফল পাওয়ার আশায় ঝাড়ফুঁক ও টোটকা চিকিৎসায় ঝাঁপিয়ে পড়া এবং এতে ফল না পেয়ে ক্ষোভ থেকে অসংগত আচরণ করা। সাংবাদিক বিতাড়ন এই রোগেরই এক পার্শ্ববিকার মাত্র।

সাংবাদিক–ভীতি আগেও ছিল। সাইবার দুর্বৃত্তরা রিজার্ভ লোপাট করায় ২০১৬ সালের মার্চে গভর্নর আতিউর রহমান পদত্যাগ করলেন। আমি তখন অর্থনীতিবিদের দায়িত্বে। হঠাৎ একজন সাংবাদিক নেতা এসে আমাকে জানালেন যে তাঁদেরকে বাংলাদেশ ব্যাংকে ঢুকতে দেওয়া হচ্ছে না। আমি হতভম্ব হয়ে একজন ডাকসাইটে ডেপুটি গভর্নরের সঙ্গে কথা বলতে গেলাম।

তিনি গর্জন করে উঠলেন। বাংলাদেশে ক্ষমতা বদল হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের সুর ও আচরণ যে পাল্টে যায়, তা আমার জানা ছিল। এরপরও মাথা ঠান্ডা করে জানতে চাইলাম, সাংবাদিক ভেতরে থাকলে আমাদের অসুবিধা কী। তিনি বললেন, এই দুঃসময়ে সাংবাদিক ঢুকতে দেওয়া যাবে না। ওরা কী লিখতে কী লিখে ফেলবে, বলা যায় না।

এই সাংবাদিক–ভীতি বা তথ্যাতঙ্ক রোগের কারণ ছিল অন্যত্র। আমরা মোটামুটি নিশ্চিত ছিলাম যে আতিউর রহমানকে সরিয়ে দেওয়ার পর আর একাডেমিক কাউকে নেতৃত্বে আনা হবে না। গভর্নর হয়ে আসবেন একজন অবসরপ্রাপ্ত আমলা, যিনি সঙ্গে নিয়ে আসবেন তাঁর সচিবালয়ের সংস্কৃতি—কড়াকড়ি, রাখঢাক, সাংবাদিকবিমুখতা ও তথ্য লুকিয়ে রাখার তাবৎ অভ্যাস।