নিরাপদ, বুদ্ধিদীপ্ত ও টেকসই পুষ্টির এক বৈজ্ঞানিক বিপ্লব নীরব এক বিপ্লব চলছে, যেখানে বিজ্ঞান মিশছে মসলা-সুগন্ধে, আর প্রতিটি আহার হয়ে উঠছে নিরাপদ, জ্ঞানসমৃদ্ধ ও সবুজ ভবিষ্যতের অঙ্গীকার।'
বাংলাদেশ এখন জনসংখ্যা বৃদ্ধি, নগরায়ণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় খাদ্যব্যবস্থাকে বৈপ্লবিকভাবে রূপান্তর করছে। ফুড টেকনোলজি-একটি বৈজ্ঞানিক প্রয়োগ-এই রূপান্তরের মূল চালিকাশক্তি, যা খাদ্য উৎপাদন, সংরক্ষণ ও নিরাপত্তার নতুন মাত্রা যোগ করছে।
কেন ফুড টেকনোলজি গুরুত্বপূর্ণ
বাংলাদেশে প্রতি বছর ৩০-৪০ শতাংশ ফলমূল ও শাকসবজি ফসল তোলার পরই নষ্ট হয় (FAO, 2022) | এদিকে, নারী ও শিশুর মধ্যে মাইক্রোনিউট্রিয়েন্ট ঘাটতি এখনো উদ্বেগজনক। WHO পরামর্শ দিয়েছে-খাদ্যে আয়রন, ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন যুক্ত করে এ সমস্যার সমাধান সম্ভব।
এছাড়া হাইপ্রেশার প্রসেসিং (HPP), ভ্যাকুয়াম ও MAP প্যাকেজিংয়ের মতো প্রযুক্তি খাবারের মান বজায় রেখে মেয়াদ বাড়াতে সাহায্য করছে।
বাংলাদেশের খাদ্য উদ্ভাবনের সংক্ষিপ্ত উদাহরণ
ভিটামিনযুক্ত চালজাতীয় স্কুল ফিডিং কর্মসূচিতে ব্যবহার।
ফ্রোজেন প্রি-কুকড মাংস, ট্রেসিবিলিটি প্রযুক্তিসহ।
শতাধিক পণ্য উৎপাদনে টেকসই উৎস ও প্রক্রিয়ায় গুরুত্ব।
ইনস্ট্যান্ট নুডলসে ক্যালসিয়াম, আয়োডিন ও প্রোটিন সংযোজন।
সোলার টানেল ড্রায়ার দিয়ে আম, মাছ ও মসলা স্বাস্থ্যসম্মতভাবে শুকানো।
হ্রাস। কোল্ড চেইন উন্নত করে খাদ্যের অপচয় ৬০ শতাংশ
কলার খোসা ও কাঁঠালের বিচি থেকে পুষ্টিকর ময়দা তৈরি।
দেশের কৃষি প্রযুক্তি ও সাপ্লাই চেইনে আধুনিক উদ্যোগ কৃষকদের জন্য Al, lot এবং স্যাটেলাইট ডেটা ব্যবহার করে ফসল পর্যবেক্ষণ, ফলন বৃদ্ধি ও সরাসরি বাজারে বিক্রয় নিশ্চিত, যা পণ্যের ট্রেসেবিলিটি বজায় রাখে।
রাসায়ন্যমুক্ত, ট্রেসযোগ্য খাদ্যপণ্য সরবরাহ, যেখানে QR কোড ভেরিফিকেশন ও স্বাস্থ্যসম্মত প্যাকেজিং রয়েছে।
একাধিক ডিস্ট্রিবিউশন সেন্টারের মাধ্যমে কৃষকদের সরাসরি খুচরা বিক্রেতার সঙ্গে সংযোগ, মধ্যস্বত্বভোগী হ্রাস ও প্রায় ৩৫ শতাংশ পণ্য অপচয় কমানো।
পোর্টেবল মাটি পরীক্ষা যন্ত্র ও বাংলা মোবাইল অ্যাপের মাধ্যমে Al-ভিত্তিক মাটির স্বাস্থ্য নির্ণয় ও সার প্রয়োগের সুপারিশ।
ব্লকচেইনভিত্তিক কৃষি সরবরাহ প্ল্যাটফরম, যা হাজারো কৃষককে ভোক্তার সঙ্গে সংযুক্ত করে, পুরো সাপ্লাই চেইনের ট্রেসেবিলিটি নিশ্চিত ও কৃষকের আয় ১০-১৫ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি।
চ্যালেঞ্জসমূহ
মাত্র ১৫ শতাংশ খাদ্যপ্রতিষ্ঠান HACCP বা ISO 22000 মানদণ্ড পূরণ করে।
কম ১০ শতাংশ সংবেদনশীল খাদ্য সঠিক কোল্ড চেইনে পরিবহিত হয়।
দক্ষ পেশাজীবীর ঘাটতি বিশেষত গ্রামীণ এলাকায় উদ্ভাবনকে ব্যাহত করে।
নিয়ন্ত্রক কাঠামো ও বৈজ্ঞানিক নজরদারি
২০১৩ সালের Food Safety Act অনুযায়ী BFSA গঠিত হয়। BSTI ১০০+ খাদ্য মানদণ্ড নির্ধারণ করে। সরকারিভাবে পরিচালিত ল্যাবগুলো এখন Gas Chromatography Mass Spectrometry (GS-MS), Enzyme-Linked Immunosorbent Assay (ELISA) ও High-Performance Liquid Chromatography (HPLC) প্রযুক্তিতে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করছে।
ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা
ল্যাব-গ্রোন মাংস ও প্ল্যান্ট-ভিত্তিক প্রোটিন নিয়ে গবেষণা চলেছে-ডাল, সয়াবিন ও কাঁঠাল দিয়ে টেকসই প্রোটিন উৎস গড়ে তোলা হচ্ছে। 3D প্রিন্টেড পুষ্টিকর স্ন্যাকস শিশু ও চিকিৎসাভিত্তিক ডায়েটের জন্য উদ্ভাবিত হচ্ছে। ব্লকচেইন প্রযুক্তি চাল ও মাংসজাত পণ্যের ট্রেসেবিলিটিতে ব্যবহার হচ্ছে।
বাংলাদেশ এখন খাদ্য ও বিজ্ঞানের যুগল পথচলায় এক বৈজ্ঞানিক বিপ্লবের পথে। গবেষণা, শিক্ষা ও সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বে বিনিয়োগের মাধ্যমে, দেশটি দক্ষিণ এশিয়ার খাদ্য প্রযুক্তিতে নেতা হয়ে উঠতে পারে। এর ফলে অপুষ্টি কমবে, অপচয় হ্রাস পাবে এবং একটি নিরাপদ পুষ্টিময় ভবিষ্যৎ নিশ্চিত হবে।
লেখক: সিইও, পরিচালক, পেস্ট্রি শেফ, ব্যাচেল অব পেস্ট্রি আর্টস, টেইলরস ইউনিভার্সিটি, মালয়েশিয়া ইউনিভার্সিটি অব টুলুজ, ফ্রান্সের যৌথ ডিগ্রিধারী